আঞ্চলিক শক্তির উত্থান

আধুনিক ভারতের ইতিহাস

আঞ্চলিক শক্তির উত্থান

● ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দের ৩রা মার্চ মহারাষ্ট্রের আহমেদনগরে ঔরঙ্গজেবের মৃত্যু ঘটে। বর্তমানে ভারতের মহারাষ্ট্র রাজ্যের আউরঙ্গাবাদ জেলার খুলদাবাদ (Khuldabad) শহরে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়।

● ঔরঙ্গজেব পরবর্তী মোগল সম্রাটগণ :

১. মুয়াজম/প্রথম বাহাদুর শাহ/প্রথম শাহ আলম (১৭০৭-১৭১২ খ্রিস্টাব্দ)

২. জাহান্দার শাহ (১৭১২-১৭১৩ খ্রিস্টাব্দ)

৩. ফারুক শিয়র (১৭১৩-১৭১৯ খ্রিস্টাব্দ)

৪. মহম্মদ শাহ (১৭১৯-১৭৪৮ খ্রিস্টাব্দ)

৫. আহম্মদ শাহ (১৭৪৮-১৭৫৪ খ্রিস্টাব্দ)

৬. দ্বিতীয় আলমগীর (১৭৫৪-১৭৫৯ খ্রিস্টাব্দ)

৭. দ্বিতীয় শাহ আলম (১৭৫৯-১৮০৬ খ্রিস্টাব্দ)

৮. দ্বিতীয় আকবর (১৮০৬-১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দ)

৯. দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফর (১৮৩৭-১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দ)

● মোগল সাম্রাজ্যের পতন :

১৫২৬ খ্রিস্টাব্দের পানিপথের প্ৰথম যুদ্ধের মাধ্যমে জহিরউদ্দিন মহম্মদ বাবর কর্তৃক যে মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল, ৩১৭ বছর পর ১৭ জন মোগল শাসকের সাম্রাজ্য পরিচালনার পর ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর সাথে সাথে তা তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়েছিল। এই সাম্রাজ্যের ভাঙনের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছিল অনেক আগে থেকেই। মোগল সাম্রাজ্যের পতনের নানাবিধ কারণগুলি ছিল-

(i) সাম্রাজ্যের বিশালতা, (ii) উত্তরাধিকার সংক্রান্ত দ্বন্দ্ব, (iii) সামরিক শক্তির দুর্বলতা, (iv) কোষাগারে অর্থ সঙ্কট, (v) নৌ-শক্তির অভাব, (vi) মনসবদারী ও জায়গিরদারী সঙ্কট, (vii) অভিজাত গোষ্ঠীর দ্বন্দ্ব, (viii) শাহজাহানের বিলাসিতা, (ix) কৃষক ও প্রজা বিদ্রোহ, (x) আঞ্চলিক শক্তির উত্থান, (xi) ঔরঙ্গজেবের দায়িত্ব, (xii) বৈদেশিক আক্রমণ। ইত্যাদি।

● ভারতে বৈদেশিক আক্রমণ :

◆ নাদির শাহ :

১. ১৭৩৮-৩৯ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ ভারত আক্রমণকারী যাকে সারাবিশ্ব নাদির শাহ নামে চেনে সেই ব্যক্তির আসল নাম হল নাদির কুলি খান।

২. পারস্যের (বর্তমানে ইরান) এক অতি দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণকারী নাদির শাহ প্রথম জীবনে মেষপালক হিসেবেই জীবনযাপন শুরু করেন। যৌবনকালে দস্যু দলের সর্দার এবং পরবর্তীকালে সাফাবি বংশীয় পারস্য সম্রাট শাহ তাহমাস্প-এর অধীনে রাজকার্যে নিযুক্ত হন। ১৭৩২ খ্রিস্টাব্দে তিনি পারস্যের সেই সম্রাটকে সিংহাসনচ্যুত করে ১৭৩৬ খ্রিস্টাব্দে নিজেকে ‘সম্রাট’ বা ‘শাহ’ উপাধিতে ভূষিত করেন। এরপর তাঁর নাম হয় নাদির শাহ।

৩. নাদির শাহ ১৭৩৭ খ্রিস্টাব্দে কান্দাহার আক্রমণ করে স্থানীয় বিদ্রোহী আফগান উপজাতিগুলিকে দমন করেন।

৪. ১৭৩৭ খ্রিস্টাব্দে নাদির শাহ প্রথম ভারত অভিযান শুরু করেন। এই সময় মোগল সম্রাট ছিলেন মহম্মদ শাহ। এই অভিযানে তিনি প্রথমে কাবুল পরে গজনী ও তারপর পাঞ্জাবে প্রবেশ করেন। সামরিক শক্তি প্রদর্শনের দ্বারা তিনি পেশোয়ার ও লাহোর দখল করে নেন।

৫. ১৭৩৯ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে পানিপথের কুড়ি মাইল উত্তরে কার্নাল নামক স্থানে মোগল সম্রাট মহম্মদ শাহ-র নেতৃত্বাধীন মোগল বাহিনীর সঙ্গে নাদিরের বাহিনীর মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হয়। কার্নালের এই যুদ্ধে পরাজিত হয়ে মহম্মদ শাহ ৫৩ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়ে নাদিরের সাথে সন্ধি স্থাপনে বাধ্য হন।

( উল্লেখ্য : হায়দ্রাবাদের দেওয়ান নিজাম-উল-মুলক ও অযোধ্যার শাসনকর্তা সাদাত খানের আমন্ত্রণে নাদির শাহ ভারত আক্রমণ করেন)।

৬. নাদির শাহ তাঁর ভারত আক্রমণের দ্বারা দিল্লি থেকে থেকে ৭০ কোটি টাকা, শাহজাহানের রত্নখচিত ময়ূর সিংহাসন, কোহিনুর মণি এবং উপঢৌকন স্বরূপ হাতি, ঘোড়া, উঠ, গবাদিপশু, দাস-দাসী ও কারিগর সহ যাবতীয় মূল্যবান দ্রব্য নিয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন।

৭. ১৭৪৪ খ্রিস্টাব্দে (মতান্তরে ১৭৪৭ খ্রিস্টাব্দে) নাদির শাহ তাঁর এক অনুচরের দ্বারা ছুরিকাঘাতে নিহত হন।

◆ আহম্মদ শাহ আবদালি :

১. আহম্মদ শাহ আবদালি ছিলেন দুররানি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। তাঁকে 'আধুনিক 'আফগানিস্তানের জনক' বলা হয়ে থাকে।

২. নাদির শাহের ভারত আক্রমণ কালে তাঁর অন্যতম সেনাপতি ছিলেন আফগান(পশতুন) যুবক আহমদ শাহ আবদালী। প্রভুর মৃত্যুর পর তিনি নিজেকে আফগানিস্তানের সম্রাট ঘোষণা করেন।

৩. সার্বভৌম ক্ষমতার প্রতীক হিসাবে আবদালী 'দূর-ই-দুরাণ' উপাধি ধারণ করেন। এজন্য আবদালির গোষ্ঠী 'দুররাণী' নামে পরিচিত হয়।

৪. ১৭৪৮ থেকে ১৭৬৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে আহমদ শাহ আবদালী মোট ৯ বার ভারতবর্ষ আক্রমণ করেন।

৫. ১৭৪৮ খ্রিস্টাব্দে আবদালির প্রথম ভারত অভিযানের সময় মুঘল বাদশাহ ছিলেন আহমদ শাহ। এই সময় মুঘল সেনাপতি ছিলেন মীরমুল্লুর। মোগল বাহিনীর সাথে মানপুরের যুদ্ধে আফগানরা পরাজিত হয়।

৫. ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে শাহ আবদালি দিল্লি দখল করেন। মোগল বাদশাহ ২য় আলমগীরের কাছ থেকে পাঞ্জাব, কাশ্মীর, সিন্ধুপ্রদেশ প্রভৃতি মুঘল এলাকা দখল করে পুত্র তৈমুরকে এসব এলাকার শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন।

৬. ১৭৬১ খ্রিস্টাব্দের ১৪ই জানুয়ারি আফগান নেতা আহমদ শাহ আবদালী ঐতিহাসিক পানিপথের প্রান্তরে পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধে প্রধান সেনাপতি সদাশিব রাও ভাউ-এর নেতৃত্বে মারাঠা বাহিনীর কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন এবং ১৭৬২ খ্রিস্টাব্দে ভারতবর্ষ ত্যাগ করেন।

বাংলা প্রদেশ

● মুর্শিদ কুলি খান (১৭১৭-১৭২৭ খ্রি:) :

প্রতিষ্ঠিত বংশ : নাসিরি।

উপাধি সমূহ :

‘মুতাম উল মুলক’ (দেশের রক্ষক)

‘আলা-উ-দৌল্লা’ (রাষ্ট্রের প্রবর্তক)

‘জাফর খান বাহাদুর নাসিরি’ (যুদ্ধে সাহায্যকারী)

‘নাসির জং’ (রক্ষক)

◆ সংক্ষিপ্ত ঘটনাক্রম-

১. মুর্শিদকুলি খাঁ ছিলেন বাংলার প্রথম নবাব। ১৭১৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি বাংলায় স্বাধীন নবাবী শাসনের প্রতিষ্ঠা করেন।

২. মুর্শিদকুলি খাঁ দাক্ষিণাত্য মালভূমির এক দরিদ্র ওড়িয়া ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।

৩. হাজি শাফি ইস্ফাহানি নামক পারস্যের (বর্তমানে ইরানের) জনৈক উচ্চপদস্থ মুঘল কর্মকর্তা (দক্ষিণাত্যে শায়েস্তা খানের দেওয়ান) ক্রীতদাস হিসেবে তাঁকে ক্রয় করেন। পরবর্তীতে পুত্রস্নেহে লালন-পালন করে উচ্চশিক্ষা প্রদান করেন এবং ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করে নাম দেন ‘মহম্মদ হাদি’ বা ‘মির্জা হাদি’।

৪. ১৬৯৬ সালের দিকে হাজি শাফির মৃত্যু হলে মহম্মদ হাদি বেরার প্রদেশে চলে যান। সেখানে দেওয়ান হাজি আব্দুল্লাহ খোরাসানী(কুরাইশি)-র অধীনে চাকরি গ্রহণ করেন। এই সময় (১৬৯৬ খ্রিস্টাব্দে) অঞ্চলটি ঔরঙ্গজেবের শাসনাধীন হয়ে পড়ে। রাজস্ব আদায়ের কাজে মহম্মদ হাদির অভিজ্ঞতা প্রদর্শন সম্রাট আওরঙ্গজেবের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কর্মদক্ষতার গুণে আপ্লুত ঔরঙ্গজেব তাঁকে হায়দারাবাদের দেওয়ান বা রাজস্ব বিভাগের প্রধান নিযুক্ত করেন।

৫. হায়দ্রাবাদে প্রশাসকের দায়িত্বে থাকাকালিন কর্মে সততা এবং দক্ষতা প্রদর্শন হেতু কারও কারও মতে ঔরঙ্গজেবই হাদিকে ইসলামে ধর্মান্তকরণ এবং ‘করতলব খান’ উপাধি প্রদানের মাধ্যমে ১৭০০ খ্রিস্টাব্দে অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের দায়িত্ব অর্পণ করে বাংলায় দেওয়ান নিযুক্ত করেন।

৬. আলোচ্য সময়ে বাংলার সুবাদার বা শাসনকর্তা ছিলেন ওরঙ্গজেবের পৌত্র (প্রথম বাহাদুর শহর পুত্র) আজিমুদ্দীন বা আজিম-উস-শান। দুর্নীতিগ্রস্ত আজিম-উস-শানের সাথে করতলব খানের বিরোধ বাঁধলে বাদশাহ আস্থাভাজন করতলবকে বাংলায় রেখে নিজ পৌত্র আজিমুদ্দিনকে নায়েব নাজিম পদ দিয়ে পাটনায় প্রেরণ করেন।

৭. নিরাপদ ভাবে কার্য পরিচালনার সুবিধার্থে করতলব খাঁ তাঁর রাজস্ব বিভাগ বা দপ্তরকে ঢাকা থেকে মকসুদাবাদ-এ(পরবর্তীতে মুর্শিদাবাদ) স্থানান্তরিত করেন।

৮. সাম্রাজ্যের ঘোরতর দু'দিনে অর্থক্লিষ্ট ঔরঙ্গজেবের মুঘল রাজকোষে নিয়মিত রাজস্ব জমা দেওয়ার কৃতিত্ব প্রদর্শনের পুরস্কার স্বরূপ ১৭০৩ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণাত্যে সাক্ষাৎকালে সম্রাট ঔরঙ্গজেব করতলব খানকে ‘মুর্শিদকুলি খাঁ’ উপাধি দান করেন। এবং তাঁর কর্মদক্ষতায় মুগ্ধ হয়ে সম্রাট তাঁকে উড়িষ্যার সুবাদার নিযুক্ত করেন। একইসঙ্গে বাংলা, বিহার ও ঊড়িষ্যার দেওয়ানি পদও লাভ করেন। এই সময় তিনি বাদশাহ কর্তৃক তাঁর নিজ নামানুসারে মুকসুদাবাদের নাম পরিবর্তন করে ‘মুর্শিদাবাদ’ রাখার অনুমতি লাভ করেন।

৯. ১৭০৪ সালে মুর্শিদকুলি খাঁ মুর্শিদাবাদে প্রতিষ্ঠা করেন একটি রাজকীয় টাকশাল (মুদ্রা উৎপাদন কেন্দ্র)।

১০. ১৭১৭ সালে মুঘল সম্রাট ফারুকশিয়র মুর্শিদকুলিকে প্রাদেশিক শাসনকর্তা বা সুবাদার হিসেবে নিয়োগ করেন। দেওয়ান ও নাজিম এর যৌথ দায়িত্ব পাওয়ার সুবাদে মুর্শিদকুলি খাঁর ক্ষমতা চূড়ান্ত হয়ে পড়ে। তিনি তাঁর প্রাদেশিক রাজধানীকে ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে স্থানান্তরিত করেন। ১৭২৭ খ্রিস্টাব্দ অর্থাৎ মৃত্যু অবধি তিনি এই পদে বহাল ছিলেন তিনি।

১১. মোগল সাম্রাজ্যের ভাঙ্গনের সুযোগে নিজ উদ্যোগে বাংলার প্রশাসনকে সম্পূর্ণ ঢেলে সাজান এবং বাংলার অভ্যন্তরে শান্তি-শৃঙ্খলা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করে নিজেকে বাংলার স্বাধীন শাসক (নবাব) রূপে আত্মপ্রকাশ করেন।

১২. রাজস্ব বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে মুর্শিদকুলি সমস্ত জায়গিরকে খালিসা বা সরকারি জমিতে পরিণত করেন। তিনি জমি জরিপ করে উৎপাদন অনুযায়ী রাজস্ব নির্ধারণ করেন এবং নিলামের ভিত্তিতে সর্বোচ্চ করদাতা কে জমি ইজারা দেন। জমিদাররা নির্দিষ্ট সময়ে ‘মাল’ অর্থাৎ ‘রাজস্ব’ প্রদানের প্রতিশ্রুতি স্বরূপ সরকারের কাছে জামিন হিসাবে একটি চুক্তিপত্র জমা রাখত। রাজস্ব আদায়ের এই পদ্ধতি ‘মালজামিনী’ (Mal Zamini) বন্দোবস্ত নামে পরিচিত।